সময় সংবাদ বিডি
ঢাকা: হরতাল-অবরোধ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা কাজ করছে। তাদের ভাবনাগুলো অসাধারণও বটে। তারা মনে করছেন, রাজনৈতিক নেতারা সুদূর প্রসারী ভাবনা ভাবলে তাদের সঙ্কট সহসাই কেটে যেতো।
এরকমই একজন আবুল কাশেম (৩০) পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। বাড়ি শ্রীপুর পৌর শহরে লোহাগাছ গ্রামে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে জীবনে ভাল কিছু করার আশায় অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন ভাওয়াল বদরে আলম বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু জীবন যুদ্ধের কাছে হেরে অবশেষে নাম লিখিয়েছেন অটোচালকের খাতায়। অভাবের সংসারে বয়স্ক মা-বাবা ও সন্তানের ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর চেষ্টা করছেন।
কেমন চলছে জীবন? জানতে চেয়েছিলাম তার কাছে। উত্তরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘ভাই, হরতাল অবরোধের মধ্যে আর কেমন আছি? যারা হরতাল-অবরোধ ডাকে তাদের তো কোনো চিন্তা নাই। হরতাল অবরোধ ডাইক্কা খালি ঘুমায়।’ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নামাইবার না পারলে থামেন, আর যদি থামাইতে না পারেন তো নামেন। জনগণ যা চায় ভালা কইরা চাইয়া দেহেন। আর আমাদের জ্বালা দিয়েন না।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, ‘এনজিও থাইক্কা ট্যাকা নিয়া একটা সিএনজি কিনছিলাম। অহন এক বেলা চললে আরেক বেলা বন্ধ থাকে। ভাত খাওয়ারই ট্যাকা হয় না, কিস্তি দিমু কেমনে?’
মাওনা চৌরাস্তার অটোরিকশা চালক মিঠু মিয়া। তাকেও ছুড়ে দিই একই ধরনের প্রশ্ন। তিনি বলেন, ‘অভাবের মধ্যে দিন কাটলেও দেহার কেউ নাই। গরগাঁও (ময়মনসিংহের গফরগাঁও) থাইক্যা মাওনা আইলাম, ভাবছিলাম ভালোই কাটবো। টিভিতে মাইয়া পোলা গাড়ি ঘোড়ায় আগুন-মাগুনের ছবি দেইখ্যা রিকশা চালাইতে না করে। কয়, হরতাল শ্যাষ হইলে চালাইও। কহন কোন দিক দিয়া ঢিল মারব, আগুন দিব তার কোন ঠিক আছে?’
শ্রীপুর রেলওয়ে ময়দানে কথা হয় ভিক্ষুক রজ্জব আলীর সঙ্গে। অন্যসব ভিক্ষুকের মতো তিনিও হাঁটতে পারেন না। দুটি পিঁড়ির উপর ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। প্রতিদিন সকালে গোসিঙ্গা ইউনিয়নের পটকা গ্রাম থেকে শ্রীপুর রেলস্টেশনে আসেন। অপেক্ষমান যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা তোলেন। তিনি বলেন, ‘ভয়ে সড়ক বা বাজারের ভেতর যাই না। কখন গণ্ডগোল লাগে কওন যায় না। সবাই দৌড়িয়া পলাইব, আমি তো দৌড়িবের পারুম না। গণ্ডগোল লাগলে সেই জায়গায়ই শ্যাষ হইবো।’ তিনি বলেন, ‘ট্রেন আসতে দেরি হলে যাত্রীগোর মন খারাপ থাকে, তারা ভিক্ষাও দিতে চায় না।’
কথা হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের লেগুনা চালক আজগর আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, ‘সব সময় একটা ডরে থাহি। সড়হে (সড়কে) কখন কি হয়। সাংবাদিক ভাই এইভাবে চলা খুব কস্টের। সংসার চালানোর কেউ না থাকায় বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়্যা গাড়ি চালাই।’
এসময় তিনি হতাশা প্রকাশ বলেন, ‘জানি না কবে হরতাল-অবরোধ থেকে রেহাই পাব।’
পৌর এলাকার প্রশিকা মোড়ে কথা হয় টাঙ্গাইলের সখিপুরের কাঠ ব্যবসায়ী আমান উল্ল্যাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাদরে মনমানসিকতা অনেক ভাল। তাদের উপদেষ্টারা হলো সবচেয়ে বড় খারাপ। তাদের মাথার ব্রেণগুলোকে সবসময়ই তারা খারাপ করে রাখে।’
দেশ নিয়ে কোনোই চিন্তা নেই মাওনা চৌরাস্তার চা দোকানি লাল মিয়ার। তিনি নির্ভারকণ্ঠে বলেন, ‘চিন্তা সব ওই ওপর ওয়ালার, যেভাবে মানুষ মারছে, ওই বিচার আল্লাই করব। আমি সরকার দল, বিরোধী দল বুঝি না। আমাগো ভোটে পাশ কইরা বাহাদুরি না দেহায়া, মানুষ বালা কেমনে চলব, তার ব্যবস্থা করেন।’
শ্রীপুর বাজারের কাঁচা মালের আড়ৎদার হোসেন আলী জানান, উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতিদিনই তার এক গাড়ি অর্থাৎ ১৫ টন আলু আসে। হরতাল অবরোধ ছাড়া প্রতি গাড়ি আলুর ভাড়া হয় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। চলমান হরতাল অবরোধে গাড়ি প্রতি ভাড়া ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দেয়া লাগছে। বেশি ভাড়া দিয়েও প্রতিদিন গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।’
শ্রীপুর কাঁচা বাজারের মাংস ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান খানিকটা আবেগাপ্লুত স্বরে বলেন, ‘আগে যে গরু কিনতাম ৩০-৪০ হাজার টাকা দিয়ে ওই গরুর দাম এখন ৫০-৫৫ হাজার টাকা। চাহিদা মোতাবেক হরতালে গরু আসে না। সে হিসাবে প্রতি কেজি মাংস ৩৩০ টাকার কম বেচলে লাভ হয় না। আর কাস্টমারের কাছ থেকে প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা চাইলে রাগারাগি করে। অহন ইমুন একটা অবস্থায় লাভ নাই বললেই চলে।
শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন পিকনিক স্পটে দর্শনার্থীর কোনো চাপ নেই। ভরা মওসুমেও কোনো ভাড়া নেই পিকনিক স্পটগুলোতে। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে নেই দর্শনার্থী। বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কের মূল ইজারাদার শ্রীপুর উপজেলার কৃষকলীগের আহ্বায়ক আলহাজ্ব কবির হোসেন জানান, হরতাল অবরোধের ৩৪ দিনে তার সাড়ে তিন কোটি ক্ষতি হয়েছে।
ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বিরামহীন দুর্ভোগে। তারা এ দুর্ভোগের জন্য দেশের প্রধান দুই দলকেই দায়ী করছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে আন্দোলন শুরু করেছে, তাতে আগামীতে ক্ষমতায় গিয়ে তারাই যে ভালো কোনো কিছু উপহার দেবে, সে নিশ্চয়তা পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। আবার সরকারেরও তীব্র সমালোচনা করছে তারা। বিরোধী পক্ষের নাশকতা বন্ধ করতে সরকারেরও অনেক ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছে সাধারণ মানুষ। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা সহজে মেনে নিতে পারছে না কেউ ই।
প্রধান দুই দলের ওপর ক্ষোভ থেকেই তারা বলছেন, সরকারকে নামাতে না পারলে নাশকতা বন্ধ করুন। আর যদি নাশকতা বন্ধ করতে না পারেন তো ক্ষমতা থেকে নেমে যান। সাধারণ মানুষ এসব আর মানতে চায় না।